শৈশব ছিল এক অদ্ভুত সুন্দর সময়। সেই সময়টায় পৃথিবীটা ছিল অনেক সরল, অনেক আপন। আজকের এই কংক্রিটের শহর আর ব্যস্ত জীবনে সেই দিনগুলোকে যখন মনে পড়ে, মনে হয় ইশ! আরেকবার যদি ফিরতে পারতাম সেই দিনগুলোয়। বিশেষ করে ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর যে আনন্দ, তা এখনকার প্রজন্ম বুঝবে না।
গ্রীষ্মের দিনে দুপুরবেলা হঠাৎ আকাশটা ভারী হয়ে যেত। কালো মেঘে ঢেকে যেত চারপাশ। বাতাস ধীরে ধীরে রুক্ষ হয়ে উঠত। আমরা ভাই-বোন আর পাড়ার বন্ধুরা মিলে তখন অপেক্ষা করতাম কখন ঝড় উঠবে। কারণ জানতাম, ঝড় উঠলেই বড় বড় গাছ থেকে ঝরে পড়বে কাঁচা-পাকা আম। আর সেই আম কুড়ানোর এক আলাদা আনন্দ ছিল।মেঘ ডাকতে ডাকতেই মা বলত, “বাড়ির ভেতরে এসো সবাই, ঝড় উঠছে।” কিন্তু আমাদের কান সেদিকে থাকত না। চোখ পড়ত গাছের ডালের দিকে। কখন কোন দিক থেকে একটা আম পড়ে যায়, সেই অপেক্ষা। ঝড়ের সাথে দুলতে দুলতে বড় বড় আমগাছগুলো যেনও নাচতে থাকত। একেকটা ডাল নুয়ে পড়ত বাতাসের চাপে। তখন মনে হতো পুরো পৃথিবীটাই বুঝি আমের গন্ধে ভরে গেছে।
ঝড় শুরু হলে আর বসে থাকার উপায় থাকত না। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই, হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ কিংবা ছোট ছোট বাতিল নিয়ে দৌড় দিতাম বাড়ির উঠোনে আর পাশের মাঠে। পা ঘষে মাটিতে হেঁটে খুঁজতাম কোথায় পড়েছে সেই কাঙ্ক্ষিত আম। কখনো আম পড়ে শব্দ হতো ‘ডুপ’ করে। কান খাড়া করে শুনে দৌড়ে যেতাম। কার আগে কে পাবে এই নিয়ে চলত ছোট্ট এক যুদ্ধ। কারো হাতে বড় আম পড়লে বাকিরা হিংসে করত। আবার কেউ পড়ে গেলে, সবাই মিলে টেনে তুলে হাসাহাসি করতাম।বৃষ্টিতে ভিজে গা ভিজে একাকার হয়ে যেত। মায়ের বকুনি থাকলেও তাতে কারো মাথাব্যথা ছিল না। ঝড়ের পর উঠোন ভর্তি আম নিয়ে আমরা এক এক করে গুনতাম। কে কতটা কুড়িয়েছে, সেটার হিসাব চলত। তারপর সেগুলো ভাগ করা হত। কেউ কেউ লুকিয়ে রাখত বড় গাছের পাকা আমটা, পরে একা খাবে বলে। কখনো কখনো আমের গায়ে কাদা লেগে থাকত। বাড়ি এসে ধুয়ে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রেখে খাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা।
আরও মজার ছিল ঝড়ের আম বিক্রির খেলা। কেউ কেউ কুড়ানো আম নিয়ে পাড়ার বড় ভাইদের কাছে বিক্রি করত। পাঁচটা আম এক টাকায়! সেই টাকা দিয়ে বরফ বা চকলেট খাওয়ার প্ল্যান হতো।সবচেয়ে দারুণ লাগত যখন সন্ধ্যায় উঠোনে বসে সবাই মিলে সেদিনের কুড়ানো আম খেতাম। কেউ ঝাল লবণ মাখিয়ে খেত, কেউ চিনি দিয়ে। দাদিমা তখন গল্প করতেন ছোটবেলায় নাকি ঝড়ের দিনে বনে ঢুকে আম কুড়াতে গিয়ে বাঘ দেখে পালিয়েছিলেন। সেইসব গল্প শুনতে শুনতে আমের টক-মিষ্টি স্বাদ মুখে লেগে থাকত।
এখন আর সেই দিন নেই। আমগাছ কমে গেছে। ঝড় উঠলেও আমরা আর আম কুড়াতে ছুটি না। স্মার্টফোনের পর্দায় চোখ রাখি। তবু মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে আবার ছোট্ট হয়ে যাই, ঝড়ে ভিজে, দৌড়ে, মাটির গন্ধ মেখে, উঠোন ভর্তি আম কুড়িয়ে সন্ধ্যাবেলা ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে খাই।
শৈশবের ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর সেই স্মৃতি আজও বুকের ভেতর অমলিন রয়ে গেছে। সময় বদলেছে, মানুষ বদলেছে, জীবন বদলেছে কিন্তু শৈশবের সেই মধুর দিনগুলো আর ফেরা হবে না। তবু স্মৃতির পাতায় সেই দিনগুলো এখনো ঝকঝকে রৌদ্রছায়া হয়ে জেগে আছে।
আজ এখানেই শেষ করছি। অন্য কোন একদিন ভিন্ন ধরনের কনটেন্ট নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হব। ততক্ষন পর্যন্ত আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।